Home বিচিত্র খবর যেভাবে বিশ্বের সেরা প্রতারক হয়েছিলেন নটবরলাল

যেভাবে বিশ্বের সেরা প্রতারক হয়েছিলেন নটবরলাল

132
0
SHARE

ইতিহাসের সেরা এক প্রতারক। যিনি তাজমহল বিক্রি করেছিলেন ৩ বার। শুধু তাজমহল নয়, লাল কেল্লা, রাষ্ট্রপতি ভবন- এমনকি ভারতীয় সংসদ ভবনও বিক্রি করেছিলেন মোটা অঙ্কের বিনিময়ে। এতটাই ধূর্ত ছিলেন তিনি, যে কাউকে বোকা বানাতেন মুহূর্তেই।

তিনিই একমাত্র ব্যক্তি; যিনি ৫০টি মিথ্যা পরিচয় তৈরি করেছিলেন। নিকৃষ্টতম এ প্রতারকের ১১৩ বছরের কারাদণ্ড হলেও পুলিশ তাকে আটকে রাখতে পারেনি। এমনকি তার মৃত্যু আজও রহস্যই রয়ে গেছে।

বলছি ইতিহাসের সেরা প্রতারক নটবরলালের কথা। তার আসল নাম মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব। তিনি বিহারের বাংরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে নটবরলাল বড় ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন স্টেশন মাস্টার।

প্রতারক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার

নটবরলালের বিশেষ এক দক্ষতা ছিল ছোটবেলা থেকেই। প্রতিবেশী তাকে একবার ব্যাংকের খসড়া জমা দেওয়ার জন্য পাঠান। সেদিনই নটবরলাল তার লুকায়িত জ্ঞান প্রয়োগ করে স্বাক্ষর জাল করার ক্ষমতা আবিষ্কার করেছিলেন। সেদিনই তিনি প্রতিবেশীর স্বাক্ষর জাল করে তার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ হাজার টাকা তুলে নেন।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নটবরলাল তার দুষ্টু জ্ঞান ও ধূর্ততার মাধ্যমে নানাভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ উপার্জন করা শুরু করেন। এরপর তিনি নিজ এলাকা থেকে কলকাতায় পালিয়ে যান। তারপর স্টক ব্রোকার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বাণিজ্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন। জানা যায়, নটবরলাল একসময় কাপড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ব্যর্থ হন।

যেহেতু নটবরলালের বাবা একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন; তাই তিনি ভারতের রেলওয়ে ভান্ডার শিল্প সম্পর্কে তথ্য জানতেন। ব্যাচেলর অব কমার্স ডিগ্রি অর্জন এবং স্টক ব্রোকার হিসেবে কাজ করায় নটবরলালের ব্যাংকিং বিষয় সম্পর্কেও পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল। নথি এবং স্বাক্ষর জাল করার দক্ষতা দিয়েই তিনি ইতিহাসের সেরা প্রতারক হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৩৭ সালে ৯ টন আয়রন চুরির অপরাধে প্রথবারের মতো গ্রেফতার হন নটবরলাল। পুলিশ জানায়, তিনি নিয়মিত পতিতাদের কাছে যেতেন। মদের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে তাদের গহনা ও অর্থ চুরি করে পালাতেন। নটবরলাল ঠিকই প্রথমবার পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে গেলেন।

এরপর থেকে নটবরলাল ১০০টিরও বেশি দোকান মালিক, জুয়েলারি, ব্যাংক এবং বিদেশিদের স্বাক্ষর নকল করে মিথ্যা পরিচয়ে লাখ লাখ রুপি উপার্জন করতে শুরু করেন। ৫০টিরও বেশি মিথ্যা পরিচয় তৈরি করেন এ প্রতারক। তিনি নিত্যনতুন উপায়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন।

বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্বাক্ষর তৈরিতেও দক্ষ ছিলেন। তিনি এতটাই ধূর্ত ছিলেন যে, বিভিন্ন কোম্পানি যেমন- টাটা, বিরলাসহ ধীরুভাই আম্বানির স্বাক্ষরও নকল করে মানুষকে ঠকিয়েছেন। নটবরলাল ভারতীয় সংসদ ভবনকে কোনো এক বিদেশির কাছে বিক্রি করেছিলেন। হাস্যকর বিষয় হলো, ওই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল সংসদ সদস্যসহ সেটি বিক্রি করা হয়েছিল।

নটবরলাল একজন ভালো অভিনেতাও ছিলেন! একসময় তিনি সাজতেন বিশিষ্ট শিল্পপতি, কখনো আবার সমাজকর্মী কিংবা অভাবি লোক। স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে কত অর্থ তুলেছেন তার কোনো হিসাব নেই!

প্রতারক যখন রবিন হুড

বিশ্বখ্যাত প্রতারক হলেও নটবরলাল ছিলেন একজন দয়ালু মানুষ। তিনি নিজ গ্রামে রবিন হুড হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কথিত আছে, তিনি নিজের উপার্জিত সব অর্থই দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের সাহায্যে বিলিয়ে দিতেন।

এলাকাবাসীর মতে, তিনি গ্রামে উপস্থিত হলেই তাকে সবাই ঘিরে ধরতেন ভালোবাসার খাতিরে। নিজ গ্রামে তার ছিল দাতব্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিবারই নটবারলাল নিজ এলাকায় গেলে বিশাল ভোজের আয়োজন করতেন। গ্রামবাসীদের ভালো-মন্দ খাওয়াতেন এবং তাদের আর্থিক সহায়তা করতেন।

জেল পালাতেন যেভাবে

নটবরলালের হাজার হাজার কুকীর্তি মধ্যে বিহারের মাত্র ১৪টি জালিয়াতি মামলার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। নটবরলালকে ১০ বারের মতো গ্রেফতার করা হলেও তাকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি পুলিশ। বেশিরভাগ সময়ই তিনি পালাতে সক্ষম হন।

নটবরলাল বেশ কয়েকবার বিচারকের সামনে বলেছেন, তিনি কারও কাছ থেকে ছিনতাই করেননি কিংবা কাউকে খুনও করেননি। যারা তাকে অর্থ দিয়েছেন; তাদের কাছ থেকেই নিয়েছেন। তিনি একবার ভরা বিচার মজলিসেই বিচারকের কাছে এক টাকা চেয়ে বসেন। বিচারকও তাকে টাকা দেন। নটবরলাল বলেন, এভাবেই না-কি তিনি মানুষের কাছে চাইলেই টাকা পেয়ে যান!

জেল পালানোর বিষয়েও তিনি ধূর্ত ছিলেন। একবার ১৯৫৭ সালে নটবরলাল কানপুর জেল থেকে পালিয়ে যান। একটি সুটকেস ভরা টাকা দেখিয়ে কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে সামনের গেট দিয়ে পালিয়ে যান নটবরলাল। এরপর কারারক্ষীরা সুটকেস খুলে দেখেন সংবাদপত্রে ঠাসা। তার জীবনকালে মোট ২০ বছর কারাভোগ করেছেন নটবরলাল।

সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ৮৮ বছর বয়সে নটবরলালকে গ্রেফতার করা হয়। বার্ধক্য এবং হুইলচেয়ার ব্যবহার করা সত্ত্বেও তিনি আবার পালাতে সক্ষম হন। ১৯৯৬ সালের ২৪ জুন পুলিশ তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন কারাগার থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়।

নটবরলালের মৃত্যু রহস্য

কানপুর জেল থেকে চিকিৎসার জন্য পুলিশ বাহিনীর অধীনে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় নয়াদিল্লি রেল স্টেশনে নিখোঁজ হন নটবরলাল। তারপরে আর কখনো দেখা যায়নি তাকে। নটবরলালের ছোট ভাই পরে সাক্ষ্য দেন, শেষবার পলায়নের কিছুদিন পরেই মারা যান নটবরলাল। তার দাহ করা হয়েছিল রাঁচিতে। তার দুই স্ত্রী এবং একটি মেয়ে ছিলেন।

২০০৯ সালে নটবরলালের আইনজীবী তার বিরুদ্ধে থাকা ১০০টিরও বেশি অভিযোগ খারিজ করার দাবি জানান। তিনি জানান, ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই মারা গিয়েছিলেন নটবরলাল। যদিও তার আসল মৃত্যু তারিখ জানা যায়নি।

বাংরার মানুষের কাছে নটবরলাল আজও এক গর্বের নাম। তার জীবনী নিয়ে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৭৯ সালে ‘মি. নটবরলাল’ এবং ২০১৪ সালে ‘রাজা নটবরলাল’ । এ ছাড়াও নটবরলালের জীবনী নিয়ে ডকুমেন্টরিও তৈরি হয়েছে। যা একটি ক্রাইম টেলিভিশন প্রোগ্রামে ২০০৪ সালে প্রচার হয়েছিল।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দুস্তান টাইমস ও ইন্ডিয়া টাইমস।