Home জাতীয় বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা তৃতীয়

বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা তৃতীয়

145
0
SHARE

বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর গুলোর তালিকায় এবার ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে তিন নম্বর। চলতি বছরে ১৪০টি দেশ নিয়ে এই তালিকা তৈরি করেছে লন্ডন ভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ই আই ইউ।

বাস করার অযোগ্য শহরের তালিকায় সর্বনিম্নে থাকা ১০ দেশের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার পরে রয়েছে মাত্র দুটি শহর। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক, এবং অপরটি নাইজেরিয়ার লাগোস।

অন্যদিকে, এই তালিকায় সবচেয়ে বেশি বাসযোগ্য শহর উল্লেখ করা হয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাকে। ভিয়েনার পরেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগারি, ভাঙ্কুবার, টরেন্টো ইত্যাদি শহর।

কিন্তু ঢাকা কি আসলেই এত খারাপ?

কী বলছে ঢাকারবাসিন্দারা?

রাজধানী ঢাকার মিরপুরে থাকেন বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থাপিকা শারমীন নাহার নিপা।

তিনি বলেন, মিরপুর থেকে তার কর্মস্থল সিদ্ধেশ্বরীতে যেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাকে। তার মতে, ঢাকা শহরে বসবাসের সবচেয়ে নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে যানজট।

পরিবহন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শারমীন নাহার নিপা।

“বাসের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা নাই, ভাড়া নিয়ে কোন শৃঙ্খলা নাই, যাত্রী তোলা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে চালকদের মধ্যে, দক্ষ চালকও নাই,” তিনি বলেন।

এ বিষয়ে বারবার আলোচনা এমনকি বড় ধরণের একটি আন্দোলন হওয়ার পরও এ খাতটিতে কোন পরিবর্তন আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় থাকেন নাদিরা জাহান। ঘর-সংসারের সামলানোর পাশাপাশি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরীও করেন তিনি।

তার মতে, তার এলাকাটি অনেক বেশি ঘনবসতি অনেক বেশি। এ কারণেই রাস্তায় যানবাহন এবং অসম্ভব যানবাহন থাকে। ফলে সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ” ঘনবসতি হওয়ার কারণে বিল্ডিংগুলা একটার গায়ে আরেকটা লেগে থাকে। ফলে অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষের প্রাইভেসিও থাকে না।”

তিনি অভিযোগ করেন, তার এলাকায় সকাল এবং বিকেল বেলা গ্যাস থাকে না বললেই চলে। সেইসাথে নিয়মিত পানি সরবরাহ পাওয়া যায় না।

“পূর্ব রাজা বাজারে আরও যেটি সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা হচ্ছে রাস্তা কাটা,” তিনি বলেন।

”একেক বার একেক কর্তৃপক্ষ এসে রাস্তা কাটে, কখনো বিদ্যুতের থেকে কাটা হচ্ছে, কখনো গ্যাস, কখনো ওয়াসা অর্থাৎ একেক জন একেক সময় রাস্তা কাটে আর মানুষজন চরম দুর্ভোগ পোহায়,” বলেন নাদিরা।

ইকোনমিস্ট-এর বিবেচ্য

এ ধরণেরই কিছু নাগরিক অসুবিধার কথা উঠে এসেছে ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ওই তালিকার বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে।

এবছর শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা, এবং অবকাঠামো।

এই দুটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা যা রয়েছে তা হল, জলবায়ু ও তাপমাত্রা, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা, খেলাধুলার সুযোগ, খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও সেবা, সড়ক-পরিবহন ব্যবস্থা, গৃহায়ন, জ্বালানী, পানি এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা।

‘প্রাণের শহর’

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের এই বিশ্লেষণকে গ্রহণযোগ্য মনে না করায় একে প্রত্যাখ্যান করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

তাদের মতে, এই তালিকায় যেসব শহরের সাথে ঢাকার তুলনা করা হয়েছে সেগুলো অনেকটা জন মানবহীন শহর বললে ভুল হবে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী ইকবাল হাবিব বলেন, ভিয়েনা বা মেলবোর্নের জনঘনত্ব ঢাকার তুলনায় নস্যি।

”মেলবোর্ন বা ভিয়েনাতে যদি ঢাকার কোন একটি এলাকার জনসংখ্যাও ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলে পুরো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে,” তিনি বলেন।

“ভিয়েনা বা মেলবোর্নে আপনি যখন দশটি ছবি তুলবেন, তারমধ্যে চারটা মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

”সেসব শহরের সাথে ঢাকাকে তুলনা করার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তারা আসলে প্রাণের শহর, মানবিক শহর, মানুষের শহরের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই আমাদেরকে এতোটা নিচে নামিয়েছে,” তিন বলেন।

মূল্যায়নে ঘাটতি?

মি. হাবিব বলেন, এই তুলনা যারা করছেন তারা বিনিয়োগ এবং পর্যটন ভিত্তিক পর্যালোচনার সাপেক্ষে এই মূল্যায়নটা করেন। সেই মূল্যায়নে ফুটফুটে শহরে চিন্তা করেন।

”কিন্তু যে শহরে একুশের প্রভাত ফেরি এবং পহেলা বৈশাখ লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্বিঘ্নে আনন্দ করে, সে শহরকে এভাবে মূল্যায়ন যারা করে তাদের মূল্যায়নের ঘাটতি বলাই বাহুল্য,” তিনি বলেন।

তবে মি. হাবিব বলেন,এর মানে এই নয় যে ঢাকা শহরে বাসযোগ্যতা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। ঢাকাকে তার সম্ভাবনার দিক থেকে বিবেচনা করলে বাসযোগ্যতার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, সে অর্থে তার বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা এবং তার বিপরীতে বসবাসযোগ্য জমির পরমাণের অনুপাত কম হওয়ায়, একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হলে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।

সমস্যা কোথায়?

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নানা ধরণের পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হাতে নেয়া হয়েছে মেট্রো রেলের মতো বড় প্রকল্পসহ নানা ধরণের পদক্ষেপ।

তবে মি. হাবিব বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে গুরুতর রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কঠোরভাবে কাজে নামতে হবে।

এ বিষয়ে অনেক ধরণের পরিকল্পনা তৈরি করা হলেও এখনো সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে মনে করেন তিনি। যার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কাজকে।

“একটি অনানুষ্ঠানিক চাঁদাবাজি এবং একটি অর্থনৈতিক কোটারিগোষ্ঠী পুরো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ভেস্তে দিচ্ছে,” তিনি বলেন।

এ ধরণের কার্যক্রম বন্ধ করতে যে ধরণের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন, সেগেুলো নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি।

কীবলছে কর্তৃপক্ষ?

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে ইকোনমিস্টের এই তালিকা নিয়ে কথা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ইকোনমিস্ট এধরণের কোন জরিপের জন্য তাদের কাছ থেকে কোন তথ্য নেয়নি।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন তথ্য না নিয়ে ইকোনমিস্ট কিভাবে এই তালিকা তৈরি সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে।

“ঢাকা যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর সে হিসেবে আমরা সার্বিক সেবা প্রদান করে এটার বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট কাজ করছি,” তিনি বলেন।

ঢাকা শহরের সিটি গ্রিনারি, পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তা, স্ট্রিট লাইট এগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আন্তর্জাতিক মানের ৩১টি খেলার মাঠ রয়েছে।

তবে প্রতিনিয়ত বাড়তি মানুষের চাপ সামলাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাব যেমন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, এবং কর্মসংস্থানের সন্ধানে মানুষ প্রতিনিয়তই ঢাকা মুখী হয়।

কম ঘনবসতি এবং বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহরের ব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সিটি কর্পোরেশন ও সরকার যৌথভাবে ঢাকাকে আরো বাসযোগ্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

“মেট্রো রেলের মতো বড় প্রকল্পের কারণে নাগরিকদের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে এটা সাময়িক,” তিনি বলেন।

তবে শহরের অন্য বিষয়গুলো যেমন, রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ, যানজট, গণ-পরিবহন, এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখার জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিবিসি