Home অন্যান্য ১৫ আগস্ট , একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গ ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ : শোয়েব আহমেদ...

১৫ আগস্ট , একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গ ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ : শোয়েব আহমেদ শিপন

259
0
SHARE

আজ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস । ১৯৭৫ সালের এই দিনে রাস্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সরযন্ত্রের অংশ হিসেবে যোদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের গোপনে লালিত কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যদের গভীর রাতের অতর্কিত হামলায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও তাদের তিন ছেলে শেখ কামাল , শেখ জামাল , শিশু শেখ রাসেল সহ শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল , শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল ও অসংখ্য আত্মীয় স্বজনদের সেদিন নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ।
১৫ আগস্টের সেই কাল রাতের হত্যাকান্ড সমগ্র পৃথিবীতে একটি ঘৃণ্য ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড হিসেবে বিবেচিত ।
আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নিহত সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং সকল শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ততকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতী নদীর তীর ঘেষা সুজলা সুফলা এক শ্যামল ছায়ায় ঘেরা শান্ত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে জন্ম নেয়া বংশের বড় ছেলেটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান ।
যাকে পিতা মাতা আদর করে খোকা বলে ডাকতো । সেই আদরের খোকাবাবু শেখ মুজিবই আজকের বাঙালি জাতির ইতিহাসের রাখাল রাজা , স্বাধীনতার স্থপতি , শতাব্দীর মহানায়ক , হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যায়ন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ( ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ) প্রতিষ্ঠা করেন । পরবর্তীতে এই ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন , ছিষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় এবং সত্তর এর জাতীয় নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা অগ্রণী ভুমিকা পালন করে ।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারিখে যখন আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য অন্যতম । পরে ১৯৫৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু একাধিক বার আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন ।
১৯৪৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতনের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগহয় তখন মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলা স্বাভাবিক ভাবেই পাকিস্তান রাস্ট্রের অধীনে চলে আসে ।
তখন থেকেই পাকিস্তানি সৈর শাসকরা পূর্ববাংলার মানুষের সাথে বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে থাকে । সামরিক/ বেসামরিক চাকুরী ও ব্যবসা বানিজ্য সহ সকল ক্ষেত্রে একটি বৈষম্য লক্ষনীয় ছিলো , এমনকি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বেলায়ও মূল্য বৈষম্য চলছিলো ।
১৯৫২ সালে যখন রাস্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববাংলায় ব্যপক আন্দোলন চলছিল সেই আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধু অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে সফল করতে ভূমিকা রেখেছিলেন । তখন থেকেই তরুন মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন প্রতিনিয়ত শোষণ নিপিড়ন ও অত্যাচার নির্যাতনের শিকার নিরীহ বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হলে পাকিস্তানের সৈর শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের চালিয়ে যেতে হবে ।
তারই ধারাবাহিকতায় চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েও দলের স্বার্থে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফার আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালে সৈর শাসকের বিরুদ্ধে গনঅভ্যুত্থান গড়ে তোলেন । যার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সৈর শাসক জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জনগনের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সরকার গঠন করার সুযোগ পায় । কিন্তু পাকিস্তানের সৈর শাসকরা নানান অযুহাত দেখিয়ে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করছিলোনা । আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানি শাসক গুষ্ঠিকে চাপ দিয়ে আসছিলো কিন্তু তারা আলোচনার নামে কাল ক্ষেপন করতে থাকে ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এতো বড়ো বিজয়কে পাকিস্তানের সৈর শাসকরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলোনা । এদিকে বঙ্গবন্ধু ও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু কোন ভাবেই আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছিলোনা । বঙ্গবন্ধুর বুজতে বাকি ছিলোনা পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার দিবেনা ।
তারই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানের শাসকদের সর্বশেষ আল্টিমেটাম দেওয়ার এবং ৭ মার্চে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় পাকিস্তানের সৈর শাসকরা ভীত হয়েপড়ে এবং পূর্ব বাংলার নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচারের নীল নকশা আঁকতে থাকেন । তারই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ গভীর রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালি জাতির উপর নির্মম গণহত্যা চালায় এবং সেই রাতেই পাক সেনারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে কারাগারে আটকে রাখেন ।
সেদিন থেকে দীর্ঘ নয় মাস বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্থরের জনগণের চরম ত্যাগ এবং মা / বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয় । এর পরেই ভারত ও আন্তর্জাতিক রাস্ট্র সমুহের চাপের কারনে পাকিস্তানের পরাজিত শাসক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় । ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বৃটেন ও ভারত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করেন ।
বঙ্গবন্ধু একটি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্থ অর্থনৈতীক ভাবে পঙ্গু রাস্ট্রের দায়িত্ব গ্রহন করলেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যোগাযোগ রক্ষাকরে বন্ধু রাস্ট্র সমুহের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর সপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে যখন বাংলাদেশকে অর্থনৈতীক ভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই ১৫ আগস্টের সেই কাল রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের মদদপুষ্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যদের জঘন্য হামলায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যাকরা হয় ।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট কাল রাতে শুধুু বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই হত্যাকরা হয়নি সেদিন হত্যাকরা হয়েছিল বাঙালি জাতির স্বপ্নকে , বাঙালি জাতির উন্নতিকে ও বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্খাকে । সেদিন হায়েনার দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁর দেহথেকে যে পরিমান রক্তক্ষরণ করেছিলো সেই রক্তক্ষরণ শুধু জাতির পিতার দেহ থেকেই হচ্ছেনা , সেই রক্তক্ষরণ সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়ে অনবরত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের এই রক্তক্ষরণ কোনদিনই শেষ হবেনা ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজকে শুধু বাংলাদেশের নেতা নন আপনি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতা । আপনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিস্ব দরবারে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আপনি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরিত হয়েছে । বর্তমান বৈশ্বিক করোনা মহামারী মোকাবিলায় আপনার গৃহীত পদক্ষেপ পৃথিবীর বিভিন্ন রাস্ট্র নেতারা অনুসরণ করছে । জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সাজা কার্যকর করা হয়েছে এবং আরো পাঁচজন হত্যাকারী বিভিন্ন রাস্ট্রে পালিয়ে আছে ।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর আরো পলাতক পাঁচ খুনীকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত ফাঁশির রায় কার্যকর করার জন্য এবং একই সাথে দাবি জানাচ্ছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও তাদের সহযোগীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার । জাতির পিতার হত্যাকান্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এটি একটি দেশিয় ও আন্তর্জাতিক সরযন্ত্রের অংশবিশেষের সু পরিকল্পিত হত্যাকান্ড । এখন সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের মূল কুশীলবদের খুঁজে বিচারের আওতায় আনা । ভুলে গেলে হবেনা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিরা সুযোগ পেলেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ।
পরিশেষে শতাব্দীর মহানায়ক , বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ১৫ আগস্টের কাল রাতে নিহত সকল শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করছি ।
যতদিন শেখ হাসিনা’র হাতে দেশ !
ততদিন নিরাপদ সোনার বাংলাদেশ !
জয় বাংলা । জয় বঙ্গবন্ধু । বাংলাদেশ চিরজীবী হোক ।

লেখক –

সাবেক ছাত্রনেতা
শোয়েব আহমেদ শিপন
সদস্য ,
যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি ,
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ।