Home সুখবর বাংলাদেশ করোনাভাইরাস: যেভাবে সেরে উঠলাম

করোনাভাইরাস: যেভাবে সেরে উঠলাম

308
0
SHARE

মো. শরীফ মাহমুদ অপু

শিল্পী আপেল মাহমুদের জাগরণের গান ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে…’ গানটি আমি ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অসংখ্যবার শুনেছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ তীরবিহীন সাগরে নৌকা যখন এদিক-ওদিক হেলেদুলে যায়, তখন জীবন বাঁচাতে যেমন মাঝিকে বৈঠা হাতে সংগ্রাম করে যেতে হয়, ঠিক তেমনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। শুধু লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হয়। আমি সংগ্রামী মানুষ; জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি ঘটেছে নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমেই। আবারো সংগ্রাম করেই যেন জীবন ফিরে পেলাম। অদৃশ্য ঘাতকের সঙ্গে আমার যুদ্ধ জয়ের গল্প বর্ণনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে পাঠকরা যদি এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জড়িয়েই যান তাহলে যেন এ লেখা থেকে কিছুটা উপকৃত হন।

পেশায় আমি জনসংযোগ কর্মকর্তা। মিডিয়ার মানুষদের সঙ্গেই আমার কাজ। বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ; তারপর ২৬শে মার্চ থেকে পালাক্রমে সরকারি ছুটি চলতে থাকে ৩১ মে পর্যন্ত। কিন্তু ছুটির মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ যেন দ্বিগুণ হলো। ছুটির মধ্যেই গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিকদের সাথে মিটিং নিয়মিত হয়ে গেল। তাছাড়া ছুটি সংক্রান্ত সভা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি করোনা-কালের আইন-শৃংখলার উন্নয়ন সংক্রান্ত সভাগুলি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সভাপতিত্বে সমাধান হচ্ছিল। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবারেও সারাদিনব্যাপী সভা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিটি সভায় নিয়মিত উপস্থিত থেকেছি। তাছাড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জননিরাপত্তা বিভাগ কর্তৃক গঠিত ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা সহায়তা সমন্বয় সেল’ এ ও আমি নিয়মিত সদস্য হিসেবে কাজ করে গেছি। সেল থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে তা সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছি। এরইমধ্যে নিজ এলাকা কুমিল্লার বুড়িচংয়ে করোনা-কালের অভাবীদের মধ্যে ত্রাণ ও ঈদের উপহার দিয়ে এসেছি। এত ব্যস্ততার মাঝেও পুুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছি। বারবার হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগানো, গ্লাভ্স ব্যবহার এমনকি আই প্রোটেক্টরও ব্যবহার করে চলেছি। এরই ফাঁকে ঘাতক ভাইরাসটি আমার দেহে প্রবেশ করে।

জ্বর ও পরীক্ষা পর্ব

মে মাসের ১৬ তারিখ শনিবার মন্ত্রণালয়ে প্রায় সারাদিন সভা চলছিল গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতে।

১৬ তারিখ রাতে খুব গরম ছিল, আমার শরীরেও অস্বাভাবিক অনুভূত হচ্ছিল। নিজের স্বভাববিরোধী হয়ে ফ্রিজ থেকে নামিয়ে এক গ্লাস বরফ ঠাণ্ডা পানি খেলাম। তখন যে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি আমার গলায় বসে মিটিমিটি হাসছে সেটা আমি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি। এভাবে ১৭ তারিখও শরীরের অস্বাভাবিকতা টের পেয়েছিলাম কিন্তু গা করিনি। ১৮ তারিখ সোমবার অফিস করি, করোনা-সেল এ কিছু কাজ করে বাসায় ফিরি। রাত দশটার দিকে এক সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি আমার কণ্ঠ শুনে জিজ্ঞেস করলেন- জ্বর আছে কি না। মধ্য রাতে শরীরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড রকম বাড়ছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক বন্ধু-বড় ভাই ডাক্তার উজ্জ্বল কুমার সাধুখাঁকে ফোনে জ্বরের অবস্থা জানালাম। সব শুনে তিনি আমাকে করোনার লক্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। তখন আমার জ্বর ছিল ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং অন্য কোনো লক্ষণ তখনো প্রকাশ পায়নি। সব শুনে আমাকে বললেন- এখনতো ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলছে, আপনি ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে ফেলেন আগে। ছোট ভাই আবিরকে নিয়ে ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ডেঙ্গু টেস্ট করালাম। ডেঙ্গু রিপোর্ট পজিটিভ এলো। ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে কাশি শুরু হলো সাথে সামান্য গলাব্যথা। উজ্জ্বলদা-কে জানালাম। দাদা শুনে বললেন, ‘অপু ভাই, আমি যা ভাবছি ওই দিকেই যাচ্ছে মনে হয়। আপনি কাল কোভিড টেস্ট করেন। আপাতত ওষুধের পাশাপাশি ডেঙ্গুর জন্য প্রচুর তরল খাবার খেয়ে যান।’

আমি স্যারকে (মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ফোন করে আমার শরীরের অবস্থা জানালাম। স্যার সব জেনে আমাকে বাসা থেকে বের হতে না করলেন এবং কোভিড পরীক্ষা করার জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার উত্তম বড়ুয়া-কে ফোন দেয়ার পরামর্শ দিলেন। রাত বারোটার পর ডাক্তার উত্তম বড়ুয়াকে ফোনে পেলাম। উনি আমাকে পরদিন সকাল ১১টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যেতে বললেন এবং একজন ডাক্তারের মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন- সে তোমার সব ব্যবস্থা করে দিবে। করোনা-পরীক্ষার কথা ধানমণ্ডি জোনের এডিশনাল এসপি বন্ধু আব্দুল্লাহিল কাফি-কে বললে সে জানালো- যে শের-ই বাংলা নগর মহিলা মহা বিদ্যালয়ে পুলিশের তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন কিছুসংখ্যক করোনা টেস্ট করে। “আপনি হাসপাতালে না গিয়ে শের-ই-বাংলানগর থানার ওসিকে বলেন, সে সব ব্যবস্থা করে দিবে।”

২০ তারিখ সকালে টেস্টের জন্য স্যম্পল দিয়ে আসলাম। ২১ তারিখ বিকেলে সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল থেকে সার্টিফিকেট পেয়ে ওসি সাহেব আমাকে ফোন করে জানায় যে আমি করোনা পজিটিভ। খবরটা পেয়ে আমি বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাই। ওসি জানে আলম আমাকে মোবাইলে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন সেদিকে আমার কোন মনোযোগই ছিল না। আমার চোখের সামনে যেন আমার দুই ছেলের ছবি ভাসছে। কথা শেষ করে উনি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের এপিএস মনির ভাই-কে আমার করোনা পজিটিভ হওয়ার খবর জানালেন; যাতে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের বাসা এবং অফিসের সবাই সতর্ক হয়ে যায়।

চিকিৎসা পর্ব

করোনা পজিটিভ জানার পর থেকেই আমি আমার মা-বাবার রুমে আলাদা হয়ে গেলাম। আমি পিতা-মাতা, ভাই, স্ত্রী সন্তান নিয়ে একসাথে থাকি। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে আমার মা-বাবা কুমিল্লার বাড়িতে যান এবং পরবর্তীতে লকডাউন এ আটকা পড়েন। মনে প্রশান্তি পেলাম এই ভেবে যে উনারা বয়স্ক মানুষ; বাসায় থাকলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। বাসায় আমার স্ত্রী সন্তান আর ভাই। করোনা পজিটিভ খবর পাওয়ার পর ওরা যেন আমার গায়ের উপর এসে পড়তে শুরু করলো। আমি এদেরকে অনেকটা ধমক দিয়ে সরিয়ে দেই। এবং খুব রাগতস্বরে বলি- আমার রুমের আশেপাশে তারা যেন না আসে। যা বলার (কী কী লাগবে) মোবাইল ফোনে বলবো। স্ত্রী মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, তোয়ালেসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমার রুমে দিয়ে গেল। ডাক্তার উজ্জ্ব দা ফোনে ১৫ মিনিটের মতো আমার একটি পরীক্ষা নিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানলেন জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট সঙ্গে কাশিসহ সামান্য গলা ব্যথা। তারপর হোয়াটসআপ -এ একটি প্রেসক্রিপশন পাঠালেন।

ডাক্তার আমাকে প্যারাসিটামল দিলেন, এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের ওষুধ দিলেন আর শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ কমাতে দিলেন মন্টিলুকাস্ট। সাথে দিলেন গ্যাসের ওষুধ, ভিটামিন সি, জিংক ও ভিটামিন ডি ট্যাবলেট। লিখে দিলেন বেশি বেশি প্রোটিন জাতীয় খাবার এবং প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে। গরম পানির ভাপ নিতে; গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতে আর লেবু, আদা, লং, মধু দিয়ে চা অথবা সবুজ চা পান করতে।

শুরু করলাম বেঁচে থাকার যুদ্ধ। খবরটি শুনে বন্ধু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এর সহকারী অধ্যাপক ডা. স্বদেশ রঞ্জন সরকার ফোন দিলেন। তার পরামর্শও নিলাম। উনিও একই প্রেসক্রিপশন দিলেন। আমাদের ২৮তম বিসিএস ফোরামে ডাক্তার বন্ধুরা ফোনে পরামর্শ দিয়েছেন।

পরদিন ২৩ মে গায়ে ব্যথা শুরু হলো; যেন বিছানায় পিঠ লাগানোটাই ছিল কষ্টের। যথারীতি ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। পিঠে গরম পানির সেক নিলাম। পরামর্শমতো তা করতে থাকলাম। পরের দিন থেকে জ্বর কমে গেল। নিয়ম করে গরগরা করতে থাকলাম, দৈনিক তিনবার ভাপ নিতে থাকলাম। প্রতিদিন ২০ মিনিট করে ভাপ নিতে থাকলাম। স্ত্রী এটা আমাকে নিতে বাধ্য করত। আমি ভাপ নিয়েছি মসলা পানি দিয়ে। এটা অনেক কষ্টের হলেও আমি আমার মত করে একটি নিয়ম করে নিয়েছিলাম। যেহেতু ২০ মিনিট ভাপ নিতেই হবে ইউটিউব থেকে ভূপেন হাজারিকার- ‘সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত’, আপেল মাহমুদের ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’- সহ মোট চারটি গান মনোযোগ সহকারে শুনতাম আর নাক-মুখ দিয়ে গরম পানির ভাপ নিতাম। ভাপ নিলে মনে হতো শ্বাসযন্ত্রের পুরোটা যেন পরিষ্কার হয়ে গেছে।

২৪ মে রোববার ঈদের আগের দিন পাতলা পায়খানা দিয়ে নতুন উপসর্গ শুরু হলো। স্যালাইন খাওয়া বাড়িয়ে দিলাম। অবশ্য ইতোমধ্যে ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ এসেছে। ওষুধ শেষ হয়ে গেলে কাফি ওষুধ কিনে দিত। এলাকার ছোট ভাই সৈকত ডাব, আনারস, তরমুজ, দুধ ইত্যাদি বাসায় পাঠাতে শুরু করে। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারসামগ্রী আমার ভাড়া বাসার ম্যানেজার কমল দত্ত করে দিত। পিপিই পরে সাহস করে সে আমার বাসার দরজা পর্যন্ত বাজার দিতে আসতো। যা হোক ঐদিন হঠাৎ ডায়রিয়া বেড়ে গেল তবে শরীরে জ্বর ছিল না। বিছানায় শুয়ে পড়ার মত অবস্থা। ডায়রিয়াটা ঈদের আগের দিন এবং ঈদের দিন আমাকে প্রচণ্ডভাবে দুর্বল করে দেয়। প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাসায় থেকেই চিকিৎসা করবো।

অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছিলেন। জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন স্যার খবর নিচ্ছিলেন।

হাসপাতলে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। অসুস্থ হওয়ায় র‌্যাব এর মহাপরিচালক আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য হাসপাতালে সিট থাকবে যখনই প্রয়োজন মনে করবা জানাবা।’ সেজন্য মনের মধ্যে অন্যরকম এক সাহস ছিল আমার। আমার জন্য পুলিশের রাজারবাগ ও ইমপাল্স হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ ছিল। কোভিড নন-কোভিড হাসপাতালে ছোটাছুটি করতেই অনেকের মৃত্যু হয়ে গেছে। যেহেতু ডায়রিয়া প্রকট ছিল সেজন্য আইসিডিডিআর’বি তে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম যাতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া যায়। স্যালাইন, ডাবের পানি ও রাইস স্যালাইন খেতে থাকি।

২৫ তারিখ ঈদের দিনে নিয়ম করে ওষুধ আর সারাদিন স্যালাইনের উপরেই ছিলাম। সাথে নিয়মে পরিণত হওয়া সকাল দুপুর রাতে ভাপ, ৫-৬ বার গড়গড়া, গরম চা ও মসলা পানি খাওয়া চলছিল। তখন দাবদাহ চলছিল। এর মধ্যেই এত গরম খাওয়া-দাওয়া, জীবনটাই যেন গরমে গরমময় হয়ে গেল। তার ওপর আমিষ, ভিটামিন খাওয়ার উপলক্ষ হিসেবে গরু, খাসি, মুরগি, ডিম , দুধ, মালটা ও কমলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল গেলা। ফাঁকি দিতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি কারণ করোনাভাইরাসের এ সময়ে নিজের বউকে কেন যেন ‘পুলিশ’ ‘পুলিশ’ মনে হয়েছে। ছোট ভাই আবিরকে মনে হয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তা। জ্বর,কাশি,গলাব্যথা আছে কিনা, ঠিকমতো খেয়েছি কিনা গরগরা গুনে গুনে পাঁচবার করেছি কিনা, শরীরের তাপমাত্রা মেপেছি কিনা, অক্সিজেন স্যাচুরেশন এর হার ৯২ এর উপরে কিনা, হার্টবিট ও স্ট্রেস কেমন ইত্যাদি খবর একটু পরপর নেয়া ছিল তাঁর কাজ। আমি ঘুমে থাকলে উঁকি দিয়ে এসে দেখতো আমার কী অবস্থা। এ দুজন গত প্রায় ২০ দিন কখন ঘুমিয়েছে আমি টের পাইনি।

ঈদের দিন সকালে আমার এক বছর বয়সী ছেলে তার মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার ঘরে এসে কোলে ওঠার আবদার শুরু করে। জোরে ডাক দিয়ে তার মাকে বলি তাকে নিয়ে যেতে। এ কয়দিন আমি সন্তান দুটোকে বেশ বঞ্চিত করেছি বলা চলে। এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে আমার করোনা-কালের ঈদটি কেটে যায়। যদিও ঈদের দিন বিকেলে বাসায় সবাই নতুন কাপড় পড়েছিল । মা-বাবাকে ছাড়া ঈদ করলাম। এদিকে আমার এলাকা বুড়িচংয়ের পূর্ণমতি গ্রামের মানুষ সবকটি মসজিদে আমার জন্য দোয়া পড়িয়েছে। আসলে মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসে সেটা হয়তো আমি জানতে পারতাম না আমার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হলে। আমার জীবন নিয়ে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া দুই থানার মানুষ যেন আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমি আক্রান্ত হওয়ার পর কুমিল্লায় আমার বয়সী বেশ কয়েকজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আম্মা আমাকে ফোনে জানালেন যে আমার আত্মীয়দের মধ্যে ৫-৬ জন আমার জন্য কোরআন শরীফ খতম দিয়েছে। করোনা-কালে মানুষের ভালোবাসাই আমার প্রাপ্তি।

নিয়ম করে ওষুধ খেতে থাকি ও যথারীতি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলি। এই সময়টাতে আমার ফোনে চাপ বাড়তে থাকে। কষ্ট হলেও সকল কল ধরার চেষ্টা করেছি। প্রতিটা ফোন কলই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে- তারা তো আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েই ফোন করেছে। ফোনে সবাই আমাকে সাহস দিত। অনেকেই আমার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করেছে জানাতো। এলাকার মানুষজন বলতো মসজিদ, কবরস্থানসহ সামাজিক কাজগুলো সম্পূর্ণ শেষ করার জন্য হলেও আল্লাহ অপুকে বাঁচিয়ে রাখবেন।

পরদিন ২৬ মে ডায়রিয়া কমে যায়; জ্বর আর ওঠেনি। কিন্তু পিঠসহ শরীরের ব্যথাটা বেশ ছিল।

২৮ মে আবার আমার ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এবার আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। ডাক্তার উজ্জ্বলদা ও স্বদেশদা নিয়মিতই প্রতিদিন আমাকে ফোন দিতেন‌। উজ্জ্বলদা আমার উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখে বললেন, ‘বেশি ওষুধ নিলে যে আপনি ভালো হয়ে যাবেন তা কিন্তু নয়। লক্ষণ অনুযায়ী যে ওষুধগুলি খেতে বলেছি সেগুলি খাবেন।’

তিনি এজিথ্রোমাইসিন ও মন্টিলুকাস্ট চালিয়ে যেতে বললেন পাশাপাশি বাকি স্বাস্থ্যবিধিও যাতে মেনে চলি সে পরামর্শ দেন।

তবে কোভিড-১৯ কে আমার কাছে চরিত্রহীন বলে মনে হয়েছে। মনে হল এ যে এক বর্ণচোরা গিরগিটি। একটা লক্ষণ কমে তো আরেকটা বাড়ে। একইভাবে ডাক্তাররাও লক্ষণ অনুযায়ী এক ওষুধ বন্ধ করে তো অন্যটা চালু করেন। এভাবে একটি রুমের মধ্যে আমার বন্দিদশা চলতে থাকে। এ এক অন্যরকম সময়। সব মিলিয়ে ২০ দিন আমি একটি রুমে।

তবে সময় কেটেছে প্রতিদিন দুটি পত্রিকা পড়ে, ইউটিউব এ গান শুনে, সুহৃদদের সঙ্গে ফোনে কুশল বিনিময় করে ও মুভি দেখে । আমি যখনই কোন সংকটে পড়ি তখনই হলিউডের ‘ট্রয়’ মুভিটা দেখি। ‘একিলিস’ চরিত্রটি বেশ আগ্রাসী; যেন সাহসী হিরোর প্রতিচ্ছবি। এ চরিত্রটি থেকে আমি সাহস সঞ্চয় করি। যদিও ব্যক্তি জীবনে আমাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘হেক্টর’ এর মত ডিফেন্সিভ ভূমিকা পালন করতে হয়। ট্রয়সহ বেশ কিছু মুভি দেখি।

আল্লাহর উপর ভরসা ও নিজের মনের উপর সাহস রেখে সময়টা পার হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার মাত্র ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হওয়ার জন্য লক্ষণ প্রকাশের প্রাথমিক পর্যায়েই বুঝতে পারা/শনাক্ত হওয়া, পারিবারিক সহযোগিতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ওষুধ সেবনই মূলত প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে দেশে যেসব মানুষ মারা গেছে তাদের বেশিরভাগেরই রোগটি শনাক্তে দেরি হওয়া, পরিবারের উপেক্ষা অথবা পূর্বে বড় কোন শারীরিক সমস্যা ছিল। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। আমার মনে সাহস ছিল, আমি জানতাম আমার ফুসফুসে ঢাকার দূষিত বায়ু ছাড়া বিষাক্ত আর অন্যকিছু নেই। আসলে এ সময় মনের জোরই প্রধান ওষুধ।

৩০ তারিখের পর থেকে আস্তে আস্তে লক্ষণগুলি কমে আসতে শুরু করে। কিন্তু নতুন করে জিহবা ও ঠোঁটের কোণে ঘা দেখা দেয়। মুখে স্বাদ ও নাকে কোনো গন্ধ পাইনি। নিয়মিত ওষুধ সেবন, ভাপ নেওয়া, গরম পানির গড়গড়া, গরম পানি ও চা পান চলতে থাকে। ইউটিউভ সার্চ দিয়ে শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়াম শিখে নিয়ে তা করতে থাকি। মতিন ভাইয়ের (চাচাতো ভাই) পাঠানো কালোজিরার তেল আর মধু মিশিয়ে দিনে ৩ বার খেতে থাকি। আমার গাফিলতির চেষ্টা থাকলেও বউ আর ছোট ভাই সেগুলো নিশ্চিত করেছে। সিদ্ধান্ত নেই পুনরায় পরীক্ষা করার কিন্তু করোনার লক্ষণগুলো যেন মনে হচ্ছে পুরোপুরি যাচ্ছে না। অপেক্ষা করতে থাকি- করোনা মহাশয় আমার শরীরে কখন শহীদ হবেন।

করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসার ১৭ দিন পর ৪ জুন পুনরায় পরীক্ষা করতে দেই। সুখের খবর হলো পরের দিন ধরণীতে আমার আগমনের দিন বিকেলে, শের-ই-বাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম ভাই হোয়াটসআপ এ আমার করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট পাঠালেন। রিপোর্ট দেখে মনের অজান্তে ছেলে দুটির কথা মনে চলে এলো। কিন্তু এবার সাথে চোখের পানিও এলো। পরক্ষণেই ভাবলাম চোখের পানি কেন আসবে? যখন রিপোর্ট পজিটিভ আসলো তখন তো চোখের পানি আসেনি। দেখলাম পরিবারের সবার মধ্যে আনন্দের হাসি। আমার ছোট ছেলেটাও হাসি দিয়ে আমার কোলে উঠার বায়না ধরলো। এবার কোলে নিয়েই নিলাম। কোলে ওঠে সে যেন লাফাতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম, এতটুকু দুধের বাচ্চা! হঠাৎ সে আনন্দিত কেন? সে কী বুঝলো?

প্রথমে আমার মা-বাবাকে জানালাম; অপরপ্রান্তে উনাদের গলার স্বর যে ভারি হয়ে যাচ্ছে সেটা টের পেলাম। তারপর মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-কে জানালাম। তিনি শুনেই মনের অজান্তেই একটি আনন্দের হাসি দিলেন। যুগ্ম সচিব হারুন স্যার, এপিএস মনির ভাইকে জানালাম। তারপর একে একে আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, বন্ধু, সুহৃদ ও এলাকাবাসী সকলকে জানালাম। মনে হল খবরটি পেয়ে সবাই এত আনন্দিত হচ্ছে যেন আমি নতুন জীবন পেয়েছি।

প্লাজমা দান করতে চাই

হ্যাঁ, আমার কাছে মনে হল আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি, সে জীবনটা মানুষের জন্য উৎসর্গ করা আমার দায়িত্ব হবে।

মনে হলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার দুটি লাইন,

“আসিতেছে শুভ দিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।”

নতুন জীবন পেয়েছি, মানুষের ভালোবাসার কাছে আমি অনেক ঋণী হয়ে গেছি। বাকি জীবনটা যেন তা শোধ করার জন্যই সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়েছেন । সেজন্য প্রথমে শুরু করতে চাই ‘প্লাজমা’ দানের মাধ্যমে। আমার রক্তের গ্রুপ বি-পজিটিভ। প্লাজমা দেয়ার মাধ্যমে কমপক্ষে দুই জন রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। নিজে সুস্থ হওয়ার ১৪ দিন পর নাকি প্লাজমা দেয়া যায়। আমি এখন প্লাজমা দানের জন্য ১৪ দিনের অপেক্ষায় আছি।