Home অন্যান্য ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’ কত দূর

ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’ কত দূর

188
0
SHARE

চলতি সপ্তাহেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক বছর পূর্ণ করলেন ইমরান খান। ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। প্রতিশ্রুতিতে পাকিস্তানকে ‘কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্র’ বানানোর কথাও বলেছিলেন তিনি। এক বছরে সেই লক্ষ্যের দিকে কতটা এগোলেন ইমরান? কী বলছে তাঁর জনগণ?

ইমরানের পথটা যে কঠিন হবে—সেটা আগেই জেনেছিলেন তিনি। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক সংকট যে মাথায় চেপে বসবে, সেটা জানাই ছিল। সেই অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এই এক বছরে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। সৌদি আরব, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কাতার ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ ১৬০০ কোটি ডলার ধার পেয়েছেন। বছর পূর্তির আগেই মন্ত্রিসভা পর্যন্ত পুনর্গঠন করেছেন। তারপরও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে বশে আনতে পারেননি। যার প্রভাব টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

করাচিতে অনলাইন ট্যাক্সি সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোহাম্মদ তারিক। সুদিনের আশায় ‘নয়া পাকিস্তান’ স্লোগানে মুগ্ধ হয়ে লাখো পাকিস্তানির মতো তিনিও ভোট দিয়েছিলেন ইমরানকে। এক বছরের মাথায় তাঁর কথায় প্রকাশ পেল স্বপ্ন ফিকে হওয়ার হতাশা। তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলুকে তারিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইমরানের কাছ থেকে অলৌকিক কিছু প্রত্যাশা করিনি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আমাদের জীবনযাত্রা একটু সহজ হওয়া উচিত ছিল।’ তারিকের মতে, এই এক বছরে পাকিস্তানের পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সবজি থেকে শুরু করে ওষুধ— সবকিছুর দাম বেড়েছে। প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ইমরান সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে।

বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স
বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স
ইমরান খানের নানা চেষ্টার পরও নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যায়নি। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে রুপির মান ৩০ শতাংশ নেমে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য, বাণিজ্য ঘাটতি ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ওপরে চলে গেছে। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন বলছে, ইমরানের আগে নওয়াজ শরিফের সরকার পুরো পাঁচ বছরে যে ঋণ নিয়েছিলেন, ইমরান এক বছর পূর্ণ না হতেই তার দুই তৃতীয়াংশ ঋণ নিয়ে ফেলেছেন। সব মিলিয়ে এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।

রাজধানী ইসলামাবাদের বাসিন্দা ইমরান আলী (৩৫) পাকিস্তানের ডন অনলাইনকে বলেছেন, ‘গত এক বছরে নিত্যপণ্যের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আমার বেতন তো সেভাবে বাড়েনি। আমার মতো মানুষের জীবন চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে।’ একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে কাজ করা ইমরান আলীর বক্তব্য, ‘এই সরকার এক বছরে যতটুকু করার কথা ছিল, ততটুকুও করতে ব্যর্থ হয়েছে।’

পাকিস্তানের ডন অনলাইনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইমরান তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে মোটা দাগে ৫১টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই এক বছরের মধ্যে তিনি একটি প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি পূরণ করেছেন। এই প্রতিশ্রুতি হলো, লুট হওয়া জাতীয় সম্পদ ফেরত পেতে টাস্ক ফোর্স গঠন। এই টাস্ক ফোর্স দুর্নীতি দমনেও কাজ করবে। বাকিগুলোর মধ্যে তিনটি আংশিক পূরণ হয়েছে, ৩২টি প্রতিশ্রুতি পূরণের কাজ চলছে। বাকি ১৫টির কাজ শুরু হয়নি।
যদিও যে প্রতিশ্রুতিটি পূরণ করেছেন, সেটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকেরা। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে ইমরান তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করছেন বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও নওয়াজের দল থেকে নির্বাচিত আরেক প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসি কারাগারে আছেন। সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয়েছে নওয়াজের মেয়ে মরিয়মকে। এর মধ্যে নওয়াজ শরিফ পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল পিএমএলের (এন) নেতা আর জারদারি তৃতীয় বৃহত্তম দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান। ইমরান অবশ্য সমালোচকদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এঁদের কারও বিরুদ্ধেই বর্তমান সরকারের আমলে মামলা করা হয়নি। আইন নিজস্ব গতিতেই চলছে।

ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। আল জাজিরায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নতুন নির্দেশনা জারি করে বলেছে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত চলাকালে তাঁর কোনো বিষয় সংবাদে প্রকাশ করা যাবে না। সমালোচকেরা বলছেন, মূলত বিরোধী নেতাদের টার্গেট করেই এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি নানা অজুহাতে পাকিস্তানের তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইমরানের ক্ষমতার বছরপূর্তির প্রাক্কালে তাঁর জন্য এক ধরনের ধাক্কা হয়ে এসেছে কাশ্মীর ইস্যু। ভারত তার সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছে। রাজ্যকে ভেঙে দুই টুকরো করা হয়েছে এবং সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন চালু করেছে। ইমরান এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা করেছেন। এক ধরনের সফলতা পেয়েছেন তিনি। বন্ধুরাষ্ট্র চীনকে কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠক বসাতে পেরেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দেওয়াতে পেরেছেন ইমরান। একে তাঁর সমর্থকেরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সফলতা বলে দাবি করতেই পারেন।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি যেমনই হোক, ইমরান ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে সক্ষম—এখনো এ আস্থা আছে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের অনেক ভক্তের। তেমনই একজন করাচির ইকতিদার শামিম। ইমরান সরকারের প্রথম বছরের পারফরম্যান্স যে সন্তোষজনক নয়, তা অবশ্য স্বীকার করেন তিনি। তবে নির্মাণ খাতের এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘ইমরান তাঁর আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় বিপর্যস্ত এক অর্থনীতি পেয়েছেন। তিনি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। পুরোপুরি দুর্যোগের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এটা করতে হয়েছে।’ শামিম বলেন, তিনি নিশ্চিত এই সরকারের মেয়াদ দুই বছর শেষে ভালো পরিস্থিতির আভাস মিলবে।

ইকতিদার শামিমের এই আশাবাদ বাস্তব হবে কিনা, সেটা নির্ভর করবে ইমরান অর্থনীতিকে কীভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে পারেন তার ওপর। করাচিভিত্তিক অর্থনীতিবিদ শহিদ হাসান সিদ্দিকী বলেছেন, অর্থনৈতিক খাতের বিবেচনায় ইমরান সরকার গড়পড়তা পারফরমেন্সও দেখাতে পারেনি।

তার মানে ইমরানকে কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্রের ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার চ্যালেঞ্জে জিততে হলে গড়পড়তা নয়, অর্থনীতিতে ভালো পারফরমেন্স দেখাতে হবে। সেই লক্ষ্য পূরণে কাগজে-কলমে তাঁর হাতে আছে প্রায় চার বছর।